বাংলার মরমি লোকসংগীত বাঙালির মন-মনন-মানস ও ভাবসাধনার অন্তরঙ্গ স্মারক। এই দর্শন-দারিদ্র্যের দেশে লোকায়ত মরমি সাধকদের সংগীত-সাধনায় জীবন ও জগতের গভীর তাৎপর্য প্রতিফলিত- এক অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী প্রেমসাধনের ধারা সেখানে নিত্যবহমান। হাসন রাজা এই চেতনা ও আদর্শের এক মহান প্রতনিধি।
শ্রীভূমি বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক হৃদয়। শীতলাং শাহ, আরকুম শাহ, শেখ ভানু, রাধারমণ, হাসন রাজা-মরমী সাধনার এ-সব ধ্রুপদী পুরুষের চারক্ষেত্র এ-পূণ্যভূমি। এই মরমী-বলয়ের কেন্দ্রে অবস্থান হাসন রাজার। তাঁর জীবন যেন উপন্যাসের বিন্যাসে রচিত-নাটকীয় বিস্ময়ে পূর্ণ। কখনো সামন্ত-স্বভাবের নিষ্ঠুর মানুষ, আবার কখনো করুণা-প্রেমে স্নাত এক রাজর্ষি। প্রবল ভোগতৃষ্ণায় তাড়িত রিপু-শাসিত এক রমণীমগ্ন পুরুষ কোনো এক মরমি ইন্দ্রজালের স্পর্শে মুহূর্তে রূপান্তরিত হয়ে যার উদাসী সাধকে। এ-হাসন রাজাকে ঘিরে গড়ে উটেছে নানা জনশ্রুতির রহস্যের জাল। তিনি নিজেকে উন্মেচিত করেছেন গানে গানে- অকপট আত্মভাষ্য রচিত হয়েছে তাঁর পদাবলিতে।
হাসন রাজা ছিলেন গানের মানুষ-সেই গানের ভেতরে প্রচ্ছন্ন রয়েছে জীবনের কামনা-বাসনা আর জগৎ-রহস্যের নানা গুপ্ত কথা। স্বশিক্ষিত এই সাধককবি অস্তিত্ব-দর্শনের এমন কথা উচ্চরণ করেছেন, যা রবীন্দ্রমননেও অনুরণন তুলেছে-কবি হয়েছেন মুগ্ধ ও প্রাণিত। তাই গ্রাম্যসাধকের দর্শনকথা দেশান্তরের মানুষের কাছেও পৌঁছে গেছে রবীন্দ্রনাথের সৌজন্যে।
হাসনের গানের ভুবনে প্রবেশ করলে দেখা যায়, এক হাতে তাঁর পানপাত্র, অন্য হাতে জপমালা। হাসনের গান তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত। তাঁর গান আঞ্চলিক হয়েও সর্বজনীন। গানই ছিল তাঁর প্রেম, তাঁর জীবন, তাঁর আনন্দ, তাঁর উপলদ্ধি, তাঁর জগৎ।
এই গানের পুরুষকে নিয়েই হাসন রাজা : মরমি মৃত্তিকার ফসল বইয়ের পরিকল্পনা। লোকসংস্কৃতিচর্চায় নিবেদিত ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী সযত্নে হাসন রাজা সম্পর্কে প্রকাশিত প্রথম প্রবন্ধ থেকে উত্তরকালের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব প্রবন্ধই সংকলিত করেছেন। ডক্টর চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত এই বইটিতে হাসন রাজার জীবন, দর্শন, সংগীত, সাধনা নিয়ে লিখিত প্রবন্ধাবলি পত্রস্থ হয়েছে। ফলে হাসন রাজা : মরমি মৃত্তিকার ফসল হাসন রাজার সামগ্রিক মূল্যায়ন ও পরিচিতির আকর গ্রন্থ হয়ে উঠেছে।