চেঙ্গিস খানের মতােই মধ্য-এশিয়ায় আবির্ভূত আরেকজন বিশ্ববিখ্যাত দিগ্বিজয়ী বীর তৈমুর লঙ। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সুদীর্ঘ পরিসর জুড়ে তার অধিষ্ঠান। মধ্যযুগের এশিয়ার। ইতিহাসে তৈমর-চরিত্র ঘটনাবহুলতা ও নাটকীয়তায় আজও সকলকে বিস্মিত করে। হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যাপক সন্ত্রাস, দেশজয়, নৃশংসতা ও বর্বরতার একটি মূর্ত প্রতীক তৈমুর। জাতিতে তিনি ছিলেন তুর্কি। স্বীয় বুদ্ধি ও ক্ষমতাবলে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তিনি দক্ষিণ রাশিয়া থেকে ভারতবর্ষ এবং মধ্য-এশিয়া থেকে তুরস্ক পর্যন্ত। তাঁকে বলা হত তৈমুর লঙ। লঙ মানে খোঁড়া। তিনি এক পায়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন বলেই খোঁড়া তৈমুর হিসেবে তিনি ইতিহাস-প্রসিদ্ধ। তিনি নিজেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর বলে পরিচয় দিতেন।
অতি সামান্য অবস্থা থেকে তিনি জীবনে উন্নতিসাধন করেছিলেন। সেই উত্থানের গল্প উপন্যাসের মতােই চমকপ্রদ। তাঁর পিতা আমির তুরগে বারলাস তুর্কিদের গুরখান গােত্রের প্রধান ছিলেন। তৈমুর লঙ ছােটবেলা থেকেই ছিলেন তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন দুর্ধর্ষ যােদ্ধা। যুবক বয়সেই তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী আমির ও সর্দারদের পরাজিত করে সমগ্র তুর্কিস্থানে একচ্ছত্র প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেশজয়ে বের হন। সুসংগঠিত সৈন্যবাহিনী, সেনা-পরিচালনার দক্ষতা, দুঃসাহসী বীরত্ব, রাজ্যজয়ের অদম্য স্পৃহা মানব-ইতিহাসে তৈমুরকে বিশিষ্ট স্থান দিয়েছে। তৈমুরের ভাগ্যে পরাজয়ের লিখন ছিল না। নির্বিচার ধ্বংস, হত্যাযজ্ঞ ও বিভীষিকার আতঙ্ক ছড়াতে ছড়াতে তিনি এক দেশ থেকে অন্য দেশে পরিব্রাজন করেছেন। তিনি আবির্ভূত হয়েছেন মধ্য-এশিয়ায়। তাঁর গৌরবময় পদচিহ্ন ও দুঃস্বপ্নময় স্মৃতির রক্তাক্ত ছাপচিত্র এঁকেছেন তিনি পারস্য ও মেসােপটেমিয়ার পথে পথে, রাশিয়া জর্জিয়া এশিয়া মাইনরে, সাইবেরিয়ার হিমশীতল তুষাররাজ্যে, আজারবাইজান, কুর্দিস্তান, আফগানিস্তান আর ইউফ্রেতিস-এর তীরবর্তী অঞ্চলে, এমনকি ভারতবর্ষের দিল্লি পর্যন্ত তৈমুরের আগ্রাসী থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। দিল্লির শাসক সুলতান মাহমুদ তােঘলককে। তিনি পরাজিত করেন। স্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা না করে প্রচুর ধনরত্নসহ তিনি ফিরে যান। সর্বত্রই তিনি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর, প্রবল প্রতাপান্বিত। যে-পথ দিয়েই গেছেন সেখানেই উড়েছে তার বিজয়ধ্বজ। তার যুদ্ধনৈপুণ্য ও রণকৌশল আজও বিস্মিত করে সকলকে। চেঙ্গিস খান ও মােঙ্গলদের ঐতিহ্য ও কীর্তিকে তিনি ধারণ করেছিলেন। সৈন্যদলকে তৈমুর পরিচালনা করতেন দলবদ্ধভাবে। ক্ষুদ্র দলের নেতৃত্বে যারা থাকতেন তাদের সকলকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন কেন্দ্রীয়ভাবে। রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সূক্ষ্মবুদ্ধির অধিকারী। তৈমুর লঙ জন্মগ্রহণ করেন ১৩৩৬ সালের ৮ এপ্রিল। সমরখন্দের শাসক হিসেবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ১৩৬৯ সালে। ১৩৭৩ সালে তিনি দেশবিজয়ে বের হন। আমুদরিয়া পেরিয়ে প্রথমেই রাশিয়ার দিকে যাত্রা শুরু হয় তাঁর। ১৪০৫ সালে মত্যর আগ পর্যন্ত তিনি ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, চীন ও ভারতের কিয়দংশ দখল করেন।