এই বইতে বাঙলা বানানের কতিপয় তাত্ত্বিক প্রশ্ন : বাঙলা বানান বিষয়ক আলোচনার গোড়ায় একটি তাত্ত্বিক সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে সংগুপ্ত আছে।সেই তাত্ত্বিক সমস্যাটির সমাধান না হওয়ার ফলে বানান-বিধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে। সহজ কথায় বলা যায়, বাঙলা ভাষায় শব্দের জাতবিচার সম্পর্কিত তাত্বিক সমস্যাই বাঙলা বানানের নিয়মের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।প্রথাগতভাবে বাঙলা শব্দকে পন্ডিতেরা ব্যুৎপত্তিগত দিক থেকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। কেউ কেউ আরো একটি বর্গ বৃদ্ধি করেছেন, তার নাম দিয়েছেন অর্ধ-তৎসম। এই বিভাজনের ভেতরে ভাষা-সংগঠনগত সৌসাদৃশ্য কতটা কাজ করে তা কখনোই সচরাচর তলিয়ে দেখা হয় না।তদুপরি, অনেক শব্দ আছে যে গুলোকে প্রথাগত চতুবর্গ কিংবা পঞ্চবর্গের আওতায় আনা যায় না।মনে করা যাক : ইংরেজী শব্দটি কি তৎসম শব্দ, তদ্ভব শব্দ, দেশী শব্দ কিংবা বিদেশী তা আমরা জানি না। ইংরেজী ভাষায় ইংরেজী শব্দটি নেই, আছে ইংলিশ। শব্দটি তৎসব নয়, তদ্ভবও নয়, বিদেশী তো নয়ই, তবে কি দেশী? ঠিক তেমনি ফরাসি শব্দটি কোন ভাষার শব্দ? সংস্কৃত নয়, তদ্ভব নয় তবে কি? অ-তৎসম বলে কোনো একক বর্গ নেই।এ ধরনের অনেক শব্দের জাত-বিচারের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। ফলে তৎসম ও অ-তৎসম দ্বিভাজন ব্যবহার করে যে বানানের নিয়ম বিধিবদ্ধ করা হয়েছে তা বিধান হিসেবে সঠিক হয়নি। বাংলা একাডেমীর বানানের নিয়মে এই ভ্রান্তি আছে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের বানানেও এই ভুল আছে।পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বানানেও আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানের নিয়মে তো ছিলই।আরো একটি সমস্যা বানানি সমস্যা সঙ্গে জড়িত, তা হচ্ছে প্রতিবর্ণীকরণের সমস্যা।ব্যাপারটি হচ্ছে বিদেশী শব্দের বানান বাঙলা বর্ণ দিয়ে করতে গিয়ে কোন্ নীতি মানা হবে তা সুনির্ধারিত নয়।প্রতিবর্ণীকরণের সঙ্গে বানান-বিধিকে গুলিয়ে ফেলে নতুন সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছে।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান সংস্কার কমিটিও এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট পথ-নির্দেশ দিতে সক্ষন হন নি।বাংলা বানান ও প্রতিবর্ণীকরণের ভেদরেখা পরিচিহ্নিত করতে পারে নি কিংবা করেন নি। তৃতীয় বিষয়টি রাষ্ট্রীয় সংবিধা, ট্রেডমার্ক, প্যাটেন্ট, কপিরাইট সংক্রান্ত আইনী কাজে ভাষা-ব্যবহারের পরিসীমা অনির্ধারিত রয়েছে। এসব বিবেচনা না করেই বাঙলা বানান নিয়মবদ্ধ করা হয়েছে।আর এসব ক্ষেত্রে ভাষা-ব্যবহার আর বানান সমতাকরণ কিংবা ভাষার বানানের নিয়ম তৈরী করার মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা অনেকেই মানতে চান না।