উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এদেশের নাগরিক জীবনে এক পালাবদল সূচিত হয়েছিল। একদিকে বাবুকালচার। অন্যদিকে নব্যশিক্ষিত ও পশ্চিমী শিক্ষায় প্রভাবিত নাগরিক সমাজ। নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেই সমাজ নানা সংস্কার-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন অচলায়তনকে ভাঙতে চেয়েছে। তাদের এই আয়োজন-আন্দোলনের অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছিল নারী। সমাজে নারীর নিচু অবস্থান থেকে, তাদের অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার থেকে, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনযাপন ও লক্ষণরেখা থেকে মুক্তি দেওয়ার কাজে যেমন সচেষ্ট হয়েছিলেন এদেশের বহু মনীষী, তেমনই কিছু সভা ও পত্র-পত্রিকা। উনিশ শতকের বামাবোধিনী পত্রিকা তাদের মধ্যে অন্যতম। ‘বামাবোধিনী সভা’ এই পত্রিকা প্রকাশ করেছিল। কয়েকজন নবীন ব্রাহ্মযুবক নারীদের ‘মানসিক উন্নতি সাধন’ কল্পে উদ্যোগী হয়ে বামাবোধিনী পত্রিকা বের করলেন ১৮৬৩ সালে। সম্পাদক উমেশচন্দ্র দত্ত। ভারতে তথা সমগ্র এশিয়ায়, বামাবোধিনী প্রথম নারী-উদ্দিষ্ট পত্রিকা। এর আগে অবশ্য ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একটি পত্রিকা (১৮৫৪-৫৫) মেয়েদের জন্য প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেটি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। বামাবোধিনী-র প্রকাশকাল দীর্ঘ ষাট বছর। যে-কোনও পত্রিকার পক্ষে এই দীর্ঘ সময় কৃতিত্ব, চাহিদা ও গুরুত্বের পরিচায়ক। পত্রিকার উদ্দেশ্য প্রথম সংখ্যাতেই স্পষ্ট বিবৃত হয়েছিল: ‘অন্তঃপুরমধ্যে বিদ্যালোক প্রবেশের পথ না করিতে পারিলে সর্ব্বসাধারণের হিতসাধন হইতে পারে না।’ শুধু বিদ্যালোক নয়, নারীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ‘প্রকৃত জ্ঞানের উদয়’ এবং ‘উৎকৃষ্ট মনোবৃত্তি প্রকাশ’ সম্বন্ধেও পরিচালকমণ্ডলী সজাগ ছিলেন। এই পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয় প্রকাশিত হত। থাকত শিক্ষাপ্রসঙ্গ, স্বাস্থ্যজ্ঞান, ভ্রমণবৃত্তান্ত, গল্প-উপন্যাস, কবিতা-চিত্রকলা, বিজ্ঞানপ্রসঙ্গ, বিদেশি নারীর সাফল্যকাহিনী, শিশুপালন পদ্ধতি, ধর্মালোচনা এবং গার্হস্থ্যজীবন। সব মিলিয়ে সর্বস্তরের পাঠিকামানসের উদ্বোধন ও উজ্জীবন। ইতিহাসের বিচারে সমসাময়িক পত্রপত্রিকাগুলির মধ্যে বামাবোধিনী উত্তুঙ্গ অবস্থানের অন্যতম দাবিদার। একদিকে উনিশ শতকের সংস্কারপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী নেতাদের মতবাদ, নারী প্রতিকৃতি সৃজন এবং সমাজে ও পরিবারে নারী-ভূমিকার মূল্যায়ন রূপায়িত করেছে বামাবোধিনী। সেদিনের সেই রূপায়ণের মূল্য এই যে, আজও তার রেশ মিলিয়ে যায়নি। সারা দেশ জুড়ে নারীসমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সঙ্কেত আজ আর অস্পষ্ট নয়। একাধারে শক্তিশালী অতীতের ভাবাদর্শের স্বাক্ষর এবং সম্ভাবনাময় এক ঐতিহাসিক সূচনার ইঙ্গিত বহন করছে এই পত্রিকা। নারীর সামাজিক অবস্থানকে স্বতন্ত্র প্রেক্ষিতে বিচার করার ক্ষেত্রে বামাবোধিনী নতুন পথের দিশারী। বামাবোধিনী নিজেই ইতিহাস। বর্তমান সংকলনে গৃহীত হয়েছে এই পত্রিকায় প্রকাশিত নারী ও পরিবার সংক্রান্ত প্রবন্ধাবলী।