পাঠকের মন পায়, তবু মান পায় না— কোনও এক সময়ে গোয়েন্দাকাহিনী সম্পর্কে হয়তো প্রযোজ্য ছিল এই উক্তি, কিন্তু আজ আর একথা বলা যাবে না। জনপ্রিয়তার দিক থেকে গোয়েন্দাগল্প প্রথমাবধি সর্বশ্রেণীর পাঠকচিত্তকে অধিকার করে রয়েছে, কালক্রমে এই কাহিনী সৃষ্টিপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছে সর্বস্তরের লেখককুলকেও। স্বাভাবিকভাবেই তাই অপসৃত হয়েছে সাহিত্যের সঙ্গে ব্যবধানের প্রাচীর। গোয়েন্দাকাহিনী হয়ে উঠেছে সাহিত্যেরই পরিপুষ্ট একটি শাখা। উন্মোচিত হয়েছে এই সত্য যে, গোয়েন্দাগল্প শুধু অবসরবিনোদনের উপকরণ নয়, নয় অবাস্তব ঘটনার ঘনঘটা কি লেখকে-পাঠকে বুদ্ধির প্যাঁচকষাকষি, বরং এর মধ্যেও নিহিত রয়েছে কিছু জরুরি সামাজিক কর্তব্য, অপরিহার্য মানবিক দায়বদ্ধতা। বেশি দূরে যাবার দরকার নেই, গত এক দশকের বাংলা সাহিত্যের কিছু ঘটনার দিকে তাকালেই এ-কথার সারবত্তা উদ্ভাসিত হবে। শ্রদ্ধেয় সুকমার সেনের মুখ্য উদ্যোগে ১৯৮৩ সালে কলকাতা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চিরজীবী গোয়েন্দা শার্লক হোম্সের নামাঙ্কিত এক গোয়েন্দা-সাহিত্যচক্র, ‘হোমসিয়ানা’। সেই সাহিত্যচক্রের সদস্য ছিলেন, এবং এখনও আছেন, বাংলা সাহিত্যের বহু দিক্পাল কবি ও কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী ও সাহিত্যপ্রকাশক। গত দশকেই প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাস-প্রণেতা সুকুমার সেনের গ্রন্থ, ‘ক্রাইমকাহিনীর কালকান্তি’—পৃথিবীর তামাম গোয়েন্দা-সাহিত্যের এক অনন্য ইতিহাস। আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই যে, পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ পর্যন্ত মেনে নিয়েছেন সাহিত্য হিসাবে গোয়েন্দাকাহিনীর প্রতিষ্ঠাকে। বাংলা সাহিত্যের সহায়ক পাঠ্যপুস্তক তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যসন্ধ-ব্যোমকেশ-কাহিনী, ‘লোহার বিস্কুট’। বাংলা ভাষায় গোয়েন্দাকাহিনীর সূচনা তৎকালীন সরকারী গোয়েন্দা দপ্তরের এক চাকুরিয়ার হাতে। চাকুরিজীবী সেই গল্পকারের নাম প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। ‘দারোগার দপ্তর’ নামে দুশোরও বেশি গ্রন্থ নিয়ে একাদিক্রমে তিনি লেখেন গোয়েন্দাকাহিনীর এক সিরিজ। এই সিরিজের প্রথম গ্রন্থ, ‘বনমালী দাসের হত্যা’। প্রকাশিত হয় ১৮৯২ সালের এপ্রিল মাসে। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দারোগার দপ্তর’-এর প্রথম গ্রন্থের প্রকাশকালটি স্মরণে রেখে আমরা বলতে পারি যে, এই ১৯৯১ সালে পূর্ণ হল বাংলা গোয়েন্দাকাহিনীর শতবর্ষ। এই দীর্ঘ এক শ বছরে বাংলা গোয়েন্দাগল্পের বহু বিবর্তন, বিস্তর বাঁক। কী সেই বিবর্তন আর কোথায়-কোথায় বাঁক, তারই নির্ভুল হদিশ তুলে ধরবে একশ বছরের বাংলা গোয়েন্দাগল্পের সুবিস্তৃত সম্ভার থেকে সযত্নে বেছে-নেওয়া পঁচাত্তরটি নানা মাপের নানা রসের গোয়েন্দারচনার এই অসাধারণ সংগ্রহ। বাংলা গোয়েন্দাকাহিনীর শতবর্ষ-পূর্তির পরম লগ্নে এ-এক অনন্য আনন্দ-অর্ঘ্য। এ-সংগ্রহের ভারপ্রাপ্ত দুই সম্পাদক, শ্রীরঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় ও শ্রী সিদ্ধার্থ ঘোষ, শুধু-যে বিশিষ্ট গোয়েন্দা-গল্প-অনুরাগী ও খ্যাতিমান লেখক তা নন, অন্যদিক থেকেও সবিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন। পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রে রহস্যরোমাঞ্চ-রচনার সঙ্গে একজনের আজন্ম পরিচয়, অন্যজনের রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণামূলক রচনার কীর্তিময় অভিজ্ঞতা। সম্মিলিতভাবে এই দুই সম্পাদক তাই এই সংকলনগ্রন্থের ব্যাপ্ত ও পরিশ্রমসাধ্য কর্মে নিজেদের অধিকারকে করে তুলেছেন সুচিহ্নিত। বাংলা গোয়েন্দাগল্পের এক শ বছরের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা সম্পর্কে সর্বাঙ্গীণ সচেতনতার এক নিচ্ছিদ্র পরিচয় এঁরা মুদ্রিত করেছেন এই সংগ্রহের অতি দীর্ঘ ও সারবান এক আলোচনায়। অপর দিকে, অসামান্য রসগ্রাহিতার নিপুণ দৃষ্টান্ত রূপে তুলে এনেছেন এই সংকলনের একেকটি উজ্জ্বল গল্প। গত এক শ বছরে বাংলা গোয়েন্দাগল্পের রচনাভঙ্গিতে, তার বিষয়ে-ভাষায়-আঙ্গিকেই শুধু যে আমূল বদল ঘটেছে তা নয়, অনিবার্যভাবে পরিবর্তন ঘটেছে মানুষের জীবনে, সামাজিক কাঠামোয় এবং মূল্যবোধেও। গোয়েন্দাগল্প সাহিত্যেরই একটি প্রধান শাখা। তাই সেই সাহিত্যেও প্রতিফলিত হতে বাধ্য এই সর্বাত্মক বদলের নানান লক্ষণ। সুখের কথা, এদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছেন এ-সংগ্রহের দুই সতর্ক সম্পাদক। গল্প-নির্বাচনে তাই তাঁরা যেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও লেখককেই স্বেচ্ছায় বাদ দেননি, তেমনই চেষ্টা করেছেন এমনভাবে গল্পগুলিকে বাছতে, যাতে কিনা সংকলিত গল্পাবলি সব-ছাপিয়ে হয়ে ওঠে একশ বছরের গোয়েন্দাসাহিত্যের তথা বাংলার সমাজজীবনের এক অকৃত্রিম ও উল্লেখযোগ্য দলিল।