সংবাদপত্রের রবিবারের পাতায় খবর কিছু কম থাকে না। কিন্তু তার সঙ্গে ওই দিনের উপরি পাওনা—গল্প, ধারাবাহিক আখ্যান, স্বাদু রম্যরচনা কিংবা ফিচার। অর্থাৎ খবরের বাস্তব অভিঘাতের পাশাপাশি পাঠক রবিবারের বিশ্রামের দিনেও পেয়ে যান তাঁর আপন রুচির মানসভোজ্য। তিনি অলস মধ্যাহ্নে সেই সুস্বাদু আহার গ্রহণ করেন পরমতৃপ্তিতে। এই রীতি এখন ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ পঁচাত্তর বছর ধরে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে আনন্দবাজার পত্রিকা তার রবিবারের পাতাটি সাহিত্যের নানা সম্ভারে সাজিয়ে পরিবেশন করেছে। এই পত্রিকার রবিবারের পাতা রবিবাসরীয় নামে শুধু বিখ্যাত নয়, পাঠকদের কাছে এক অবশ্যপাঠ্য ক্রোড়পত্র, তাঁদের মননলোকের প্রিয় আধার। অন্যান্য রচনাসমূহ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র রবিবাসরীয়তে পঁচাত্তর বছরে যত ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে, তার সম্পূর্ণ তালিকায় চোখ রাখলে বিস্মিত হতে হয়। লেখক-লেখিকার নামের তালিকায় শরৎচন্দ্র ছাড়া প্রায় সবাই উপস্থিত। এই সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘রবিবার’। শেষ বয়সে সংবাদপত্রের জন্য তাঁর এই প্রথম গল্প রচনা। এখানেই একসঙ্গে দেখা মেলে তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। গল্প লেখার বৈশিষ্ট্যে, ভাবনার প্রকাশে, ভঙ্গিমার মাধুর্যে স্বতন্ত্র হলেও রবিবাসরীয়তে লিখেছেন সেকালের প্রায় সকল সাহিত্যস্রষ্টা এবং একালের প্রতিষ্ঠিত ও নবীন লেখক-লেখিকারা। এঁদের সঙ্গে আছেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর একমাত্র বড়দের জন্য লেখা গল্প ‘পিকুর ডায়েরী’ প্রকাশিত হয়েছিল এখানেই। ছোটগল্পের রূপলক্ষণ নির্দেশ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনটা বিপুল একটা বনস্পতির মতো। তার আয়তন, তার আকৃতি সুঠাম নয়। দিনে দিনে চলছে তার মধ্যে এলোমেলো ডালপালার পুনরাবৃত্তি। এই স্তূপাকার একঘেয়েমির মধ্যে হঠাৎ একটা ফল ফলে ওঠে, সে নিটোল, সে সুডৌল, বাইরে তার রঙ রাঙা কিংবা কালো, ভিতরে তার রস তীব্র কিংবা মধুর। সে সংক্ষিপ্ত, সে অনিবার্য, সে দৈবলব্ধ, সে ছোট গল্প’। ছোটগল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই সংজ্ঞার সর্বোত্তম উদাহরণ রবিবাসরীয়তে প্রকাশিত গল্পগুলি। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব গল্পই আয়তনে ছোট। স্থানাভাবের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাপে গল্পগুলি লিখতে হয়েছে। এই নাতিদীর্ঘ সীমাবদ্ধতাই রবিবাসরীয় গল্পের স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন। এ এক ধরনের পরীক্ষামূলক রচনা, যার গদ্য মেদহীন, গতি স্বচ্ছন্দ, সংলাপ যথাযথ এবং ইস্পাতের মতো ধারালো। গল্প লেখার এই মিতায়তন আঙ্গিক বাংলা সাহিত্যে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। ছোটগল্পের যে-সূক্ষ্মতা, তীক্ষ্ণ একাগ্রতা, মুহূর্তবোধের চকিত আলোর উদ্ভাস, তা রবিবাসরীয়তে প্রকাশিত গল্পমালার একান্ত সম্পদ। আর কোনও পত্র-পত্রিকায় একসঙ্গে এতজন গল্পস্রষ্টার সমাবেশ যেমন কখনও হয়নি, তেমনই পাওয়া যাবে না একসঙ্গে এতগুলি বিষয়বৈচিত্র্যে সার্থক ছোটগল্পের সমাহার। সব মিলিয়ে পঁচাত্তর বছরের এই গল্পসংগ্রহ বাংলা ছোটগল্পের একটি নির্ভরযোগ্য দলিল।