‘কেশে মাখা কুন্তলীন,রুমালেতে দেলখোস,পানে খাও তাম্বুলীন,ধন্য হোক এইচ বোস।’পদ্যাকারে রচিত এই পঙ্ক্তি-চতুষ্টয় সব-মিলিয়ে নিতান্তই একটি বিজ্ঞাপন। ‘কুন্তলীন’ নামের কেশতেল, ‘দেলখোস’ নামের সুগন্ধি এবং ‘তাম্বুলীন’ নামে পানমশলা ব্যবহারের পরামর্শ-যোগানো এক কাব্যবিজ্ঞপ্তি। এই বিজ্ঞাপন নিয়মিত প্রকাশিত হত আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে, তখনকার দিনের সংবাদপত্রে ও সাময়িকীতে। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন কবেই মিটে গেছে, তবু এই বিজ্ঞাপন আজও অবিস্মরণীয়। কাগজের পৃষ্ঠা থেকে একদা ফিরেছে মানুষের মুখে-মুখে, মুখ থেকে স্থান পেয়েছে হৃদয়ে-স্মৃতিতে, স্মৃতি থেকে মুদ্রিত হয়েছে সাহিত্যের পৃষ্ঠায় । সত্যজিৎ রায় তাঁর স্মৃতিপথের পাঁচালী ‘যখন ছোট ছিলাম’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন এই বিজ্ঞাপন। রাধারামণ মিত্র তাঁর ‘কলকাতা দর্পণ-এ সংকলিত করেছেন এই ছড়াটির একাধিক পাঠভেদ, ঠিক যেমন ঘটে থাকে লৌকিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে। বস্তুত, সাহিত্যের সঙ্গেই চিরকালের জন্য মিশে আছেন এই অভিনব বিজ্ঞাপনের স্রষ্টা তথা প্রচারিত বিপণন-সামগ্রীর নির্মাতা ‘এইচ বোস’ নামের বিচিত্রকর্মা মানুষটি। ‘এইচ বোস’ ওরফে হেমেন্দ্রমোহন বসু। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে-সব বাঙালী ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করে বিশেষ উদ্যম ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁদেরই অন্যতম, হয়তো-বা প্রধানতম, হেমেন্দ্রমোহন বসু। বহুব্যাপ্ত ও বৈচিত্র্যময় তাঁর উদ্যোগ-পরিধির অন্তর্গত ছিল প্রসাধন সামগ্রী, কলের গান, সাইকেল, মোটরগাড়ি, ফোটোগ্রাফি, ছাপাখানা প্রভৃতি। প্রতি ক্ষেত্রেই তাঁর বিপুল সাফল্য ও সুকল্পিত প্রচার-পরিকাঠামো আলাদাভাবে আলোচনার যোগ্য। এখানে শুধু বলব ‘কুন্তলীন’ কেশতেলের কথা, সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে চিরকালীন যোগ-সম্পর্কে যা জড়িয়ে গেছে—কুন্তলীন-পুরস্কারের সূত্রে। কুন্তলীন তেলের প্রচারের জন্যই অভিনব কুন্তলীন সাহিত্য পুরস্কারের প্রবর্তন করেছিলেন হেমেন্দ্রমোহন। এ-ব্যাপারেও তাঁর ভূমিকা অগ্রপথিকের। কখনও-কখনও কবিতা-ছড়াও পুরস্কৃত, তবু কুন্তলীন পুরস্কার প্রতি বৎসর দেওয়া হত মুখ্যত গল্পরচনার জন্যই। পুরস্কৃত রচনাবলি নিয়ে প্রকাশিত হত একটি বার্ষিক সংকলন। হেমেন্দ্রমোহন চেয়েছিলেন, ‘গল্পের সৌন্দর্য কিছুমাত্র নষ্ট না করিয়া কৌশলে কুন্তলীন এবং এসেন্স দেলখোসের অবতারণা’ করতে হবে লেখককে, অর্থাৎ পুরস্কারার্থী লেখা যেন ভুলক্রমেও ‘বিজ্ঞাপন বিবেচিত না হয়।’ বিপণন-সামগ্রীর সূত্রে কোনও প্রস্তুতকারক সংস্থা এর আগে পুরস্কার ঘোষণা করে সাহিত্যচর্চায় উৎসাহদানের কথা ভাবেননি। এই নতুন পুরস্কার তাই শুধু বঙ্গদেশে নয়, সারা ভারতবর্ষের লেখক ও পাঠক মহলে জাগিয়েছিল অভূতপূর্ব আলোড়ন। পুরস্কৃত লেখকদের ঠিকানা থেকেই আঁচ করা যায়, কতদূর বিস্তৃত ছিল এই পুরস্কারের খ্যাতির গণ্ডি। পরবর্তীকালে সুপ্রতিষ্ঠিত বহু সাহিত্যিক ‘কুন্তলীন’ পুরস্কার পেয়েছিলেন। অনেকে আবার একাধিকবার। তার থেকেও বড় কথা, কুন্তলীন পুরস্কারের সম্মানিত হয়েছে এমনও বহু চমকপ্রদ গল্প, যার লেখক হয়তো এ-পুরস্কারের বিদ্যুৎ-ঝলকেই একবারমাত্র উদ্ভাসিত হয়ে চিরদিনের মতো হারিয়ে গিয়েছেন। কুন্তলীন পুরস্কার-এর এই অমূল্য রচনা থেকেই নির্বাচিত একশোটি গল্প নিয়ে এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অসামান্য একটি সংগ্রহ, ‘কুন্তলীন গল্প-শতক’। একালের পাঠকগোষ্ঠির কাছ থেকে অভাবনীয় সমাদর পেয়েছে সেই সংগ্রহ। অনেকেই আগ্রহ জানিয়েছেন, কুন্তলীন পুরস্কারে সম্মানিত অন্যান্য গল্প সম্পর্কে। সেই সমাদর আর সেই আগ্রহের কথা মনে রেখেই কুন্তলীন-পুরস্কারপ্রাপ্ত অবশিষ্ট গল্পগুচ্ছ থেকে নতুন নির্বাচনে সাজিয়ে দেওয়া হল নতুনতর আরেকটি সংগ্রহ, এই ‘আরও কুন্তলীন’। প্রথমটিতে যেমন, এখানেও তেমনই স্থান পেয়েছে কালজয়ী সেইসব গল্প, বিজ্ঞাপনের অনুষঙ্গে রচিত হলেও সাহিত্যিক আবেদনে যা বাংলা কথা-সাহিত্যেরই গর্ব, যেসব গল্পে ধরা আছে সমকাল, সমসময় ও চিরকালের মানুষের আশ্চর্য প্রতিচ্ছবি। ঐতিহাসিক এই সংকলন আসলে বাংলা সাহিত্যেরই হারিয়ে-যাওয়া একটি ধারার গৌরবোজ্জ্বল পুনরুদ্ধার।