যেমন রোম নগরী, কলকাতাও তেমনই এক দিনে কি এক বছরে গড়ে ওঠেনি। বরং কোন্ ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সুতানুটি-কলিকাতা-গোবিন্দপুর নামের অখ্যাত তিন গ্রাম ধীরে-ধীরে এবং ধাপে-ধাপে রূপান্তরিত হল আজকের এই কলকাতায়, এই ঐতিহ্যমণ্ডিত তথা ঐতিহ্যবিস্মৃত মহানগরীতে, কীভাবে তার গলি আর রাজপথ, প্রাসাদ আর উদ্যানের সঙ্গে একদা মিশেছে সমাজ-সংস্কৃতির নানান সজীব উপাদান, আবার সেইসব উপাদানের অনেকটাই ক্রমশ মিশতে শুরু করেছে ধুলায়—তা আজ দারুণ কৌতূহলকর এক কাহিনী। সে-কাহিনী যতটা জানা, ততটাই অজানা। জানা-অজানা সেই কাহিনীই এই দীর্ঘ পরিশ্রমজাত বইতে শুনিয়েছেন অজিতকুমার বসু। পুরসভার পথ-নামকরণ উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে দীর্ঘকালীন যোগাযোগ লেখকের। একদিকে যেমন কলকাতা বিষয়ক বহু দুর্লভ নথিপত্র দেখার সুযোগ ঘটেছে তাঁর, অন্যদিকে তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে এই সত্যও যে, কলকাতার পথঘাটের ঘন ঘন নাম পরিবর্তনের জোয়ারে এবং আধুনিক নগরসভ্যতার দম্ভের প্রতীক বহুগ্রাসী আর বহুতল কংক্রিটের স্তুপের আড়ালে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে ইতিহাসের বহু অমূল্য ও অন্তরঙ্গ সাক্ষ্য। মুখ্যত, এ-দুইয়ের ভিত্তিতেই তিনি উদ্যোগী হন লুপ্তপ্রায় এই ইতিহাসকে গ্রন্থাকারে ধরে রাখতে। অবশেষে, প্রায় বারো বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে-গবেষণায় তিনি উপহার দিয়েছেন এই বই। কলকাতার রাজপথের নামকরণের সূত্রে কলকাতার পত্তন ও উন্নয়নের, তার সমাজ ও সংস্কৃতির যে-ইতিহাস এই বইতে তুলে ধরেছেন লেখক তা শুধুই নীরস নথিপত্রে ছড়ানো বহিরঙ্গ বিবরণ নয়। একইসঙ্গে অন্তরঙ্গ বহু উপাদানও সংগ্রহ করতে চেয়েছেন তিনি, আর সেই কারণে দ্বারস্থ হয়েছেন কলকাতার নানান অঞ্চলের প্রবীণ বাসিন্দাদের। এই দ্বিবিধ সূত্রে সংগৃহীত তথ্যের এক অনন্য সমাহার এই গ্রন্থকে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র মর্যাদা। আশা করা যায়, কলকাতাকে যাঁরা ভালবাসেন, কলকাতাকে যাঁরা জানতে চান, তাঁদের সানন্দসঙ্গী হবে এই বই।