আবার প্রকাশিত হল সেই অসাধ্যসাধন চরিতকথা। পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত কলেবরে, নতুন সংস্করণে। গত শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষকে নিয়ে এই শতকের অনন্য এক গবেষকের সেই অপ্রতিম জীবনীগ্রন্থ। যে-গ্রন্থ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্যরত্ন লিখেছিলেন, “এই একখানি গ্রন্থ পড়িলেই বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে বোধহয় কোনও বিষয়ই আর অজানা থাকে না।”উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও। একটি চিঠিতে লেখককে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলেন তিনি, “এর আগে বিনয় ঘোষ তাঁর উপর কাজ করেছেন বৃহৎ কাজ; কিন্তু তারপরেও অনেক অবকাশ ছিল— অনেক শূন্যতা ছিল— তা তুমি পূর্ণ করেছ।”জীবনীগ্রন্থ-রূপে ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’-এর অনন্যতা কোথায়, লক্ষ করেছিলেন এ-গ্রন্থের সমালোচক তথা গুণগ্রাহী প্রমথনাথ বিশীও। লক্ষ করেছিলেন, পাশ্চাত্য প্রভাবে এক শ্রেণির জীবনী লেখার চল হয়েছে ইদানীং। এ-ধরনের জীবনীকে বলা যায়, রম্যজীবনী। যতখানি রম্যতা ওই ধরনের জীবনীগ্রন্থে, জীবনী ততটাই উপেক্ষিত। আবার, আরেক শ্রেণির জীবনী-গ্রন্থও লেখা হয়। সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতির প্রাচুর্যে সেই শ্রেণির জীবনীগ্রন্থ প্রায়শই লক্ষ্যভ্রষ্ট, কেননা আসল মানুষটিই সেখানে বাদ পড়ে যান। “ইন্দ্রমিত্র এই দুই শ্রেণীকে পাশ কাটিয়ে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন, সে-পন্থার মহান পূর্বসূরী বসওয়েল ও লকার্ট” —মন্তব্য করেছিলেন প্রমথনাথ বিশী। মন্তব্য করেছিলেন যে বিদ্যাসাগরের জীবনের “এই কাহিনী ইন্দ্রমিত্র বলেছেন, তথ্যের পর তথ্য সাজিয়ে, গল্পের পর গল্প বিন্যাস করে, ঘটনার পর ঘটনা খাড়া করে তুলে।” এবং শেষাবধি তাঁর এই কাজ “শিল্পীর কাজ।”বস্তুত, গবেষণা কীভাবে হয়ে ওঠে শিল্প, শুধু তথ্য-সমাহার নয়, একইসঙ্গে তথ্যের বিশ্লেষণ এবং যাথার্থ্যবিচারও সার্থক জীবনী রচনার ক্ষেত্রে যে কত জরুরি, এই প্রথম তারও এক অনুপম আদর্শ তুলে ধরল এই জীবনীগ্রন্থ, এই ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’। দীর্ঘদিনের দুর্লভ পরিশ্রমে যাবতীয় অলীক কাহিনির আড়াল থেকে, অসার কিংবদন্তির আচ্ছাদন সরিয়ে বিদ্যাসাগর ও সমসময়কে অবিকল চেহারায় এই গ্রন্থে ফিরিয়ে এনেছেন ইন্দ্রমিত্র। তাঁর নিষ্ঠা ও নৈপুণ্য, সাহস ও শ্রদ্ধা, বিচারপদ্ধতি ও বিশ্লেষণভঙ্গিও এক দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।