এই আমার দেশ। আমার জন্মভূমি—সমগ্র ভারতবাসীর অন্তর থেকে এই অঙ্গীকার সবসময় উচ্চারিত হয় না। ভৌগোলিক গণ্ডিতে আবদ্ধ কোনও কোনও অঞ্চলের মানুষ ভারতের মূলস্রোত থেকে, জীবন দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়। এমনই একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল পশ্চিমবাংলার উত্তরে, দার্জিলিং পাহাড়ে। শান্ত, নির্জন, রৌদ্রস্নাত, হিমস্পর্শী সেই পাহাড়ে জ্বলে উঠেছিল অশান্তির আগুন। এই উপন্যাসের সমগ্র কাহিনীর ওপর আলোর মতো ছড়িয়ে আছে যে-তরুণটি, যার নাম সায়ন, সে তখন পাহাড়ে এসেছে তার দুরারোগ্য অসুখের চিকিৎসা করাতে। ডাক্তার আঙ্কলের ছোট্ট সেবাকেন্দ্র ‘নিরাময়’-এ। ডাক্তার আঙ্কল এখানে সেবাব্রতের যে-দীপশিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছেন তা আপন শক্তিতে অনির্বাণ। ব্রাউন, ম্যাথুজ, কঙ্কাবতী, পদমবাহাদুর, ডাক্তারতামাং, ছোটবাহাদুর, আমেরিকান মহিলা এলিজাবেথ প্রমুখ অনেকে নিরাময়ের প্রতিবেশী, সহায়ক কিংবা শুভানুধ্যায়ী। এঁদের সকলের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে সায়ন। সায়ন কে ঘিরে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক মিথ। ব্রাউন তার মুখের আদলে খুঁজে পেয়েছেন যিশুর মুখের সাদৃশ্য। সায়নই কি সেই চিরন্তন পরিত্রাতা মহামানব? এমন একটি সম্ভাবনা সায়নের মানন্দিনীর বুকের ভেতরেও উঁকি দিয়ে গেছে। এমনকী দরিদ্র অশিক্ষিত পাহাড়িরাও ভেবেছে সায়ন দেবলোকের কেউ। পাহাড়ে সায়নকে ঘিরে যখন তৈরি হয়েছে এক একটি কাহিনীবলয়, তখন কলকাতায় তাদের পুরনো রায়বাড়ির উনিশ শতকী রীতিনীতির অস্থি পঞ্জরে বেজে উঠেছে ভাঙনের সুর। ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছে বিদ্রোহের আগুন। সেই আগুনের ও ইন্ধন লিউকোমিয়া রোগাক্রান্ত সায়ন। অথচ এই অগ্নিভ ছেলেটিকে একদিন গ্রাস করল পাহাড়েরই হিংস্র অগ্নি ব্যাঘ্র।পাহাড়ের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা ও কাজ শুরু করেছিলেন এলিজাবেথ। তাকেই একদিন নগ্ন করে চরম অপমান করল জিপে-চড়ে-আসা চারজন উদভ্রান্ত যুবক। সায়ন তার অসুস্থ শরীরে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল আপ্রাণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নিজেই ধরা পড়ল জ্বলতে থাকা জিপের অগ্নি-আলিঙ্গনে। জ্বলন্ত আগুনের সেই রথ ক্রমশ আকাশ অধিকার করে চলে গেল আরও দূরতর কোনও আকাশে। তারপর লক্ষ লক্ষ অগ্নিরথ হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ব্রহ্মাণ্ডে। সমরেশ মজুমদারের এই উপন্যাসের ব্যাপ্তি কেবল পাহাড় থেকে সমতল নয়, মানুষের হৃদয় গহন থেকে আবিশ্বমহাকাশ। এমন জীবন পরিব্যাপ্ত উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যে খুব বেশি লেখা হয়নি।